ঢাকায় ব্যর্থ ৫২ কোটির ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম, বসছে জাতীয় মহাসড়কে

Passenger Voice    |    ০২:০৭ পিএম, ২০২২-১০-১৯


ঢাকায় ব্যর্থ ৫২ কোটির ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম, বসছে জাতীয় মহাসড়কে

রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা গুনে প্রয়োজন অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেয়া হবে ট্রাফিক সিগন্যাল। কোনো গাড়ি সিগন্যাল অমান্য করলে সেটাও শনাক্ত হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকবে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম। তবে সেখানেও খুব একটা কাজ নেই দায়িত্বশীলদের। যানজট ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ, রাস্তার শৃঙ্খলা ধরে রাখাসহ আনুষঙ্গিক সব কাজই করে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। নগরবাসীকে অনেকটা স্বপ্ন দেখিয়েই ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম বা আইটিএসের এ প্রযুক্তি ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকার ব্যস্ততম গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া ট্রাফিক মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৫২ কোটি টাকা। তবে শুরুতেই হোঁচট খায় প্রযুক্তিটি। উল্টো যানজট বাড়িয়ে দেয়। ফলে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে আগের পদ্ধতিতে অর্থাৎ ট্রাফিক পুলিশের ইশারায় ফিরে যাওয়া হয়।

ঢাকার সড়ক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সেই আইটিএস প্রযুক্তি এবার ঢাকা-পটুয়াখালী মহাসড়কের ৪০ কিলোমিটারে পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি প্রকল্প এরই মধ্যে অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এতে খরচ ধরা হয়েছে ১২২ কোটি টাকা। একই ধরনের আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জয়দেবপুর-রংপুর মহাসড়কেও। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। যদিও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো এবং বিদ্যমান যানবাহন ব্যবস্থাপনায় আইটিএসের মতো অত্যাধুনিক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি খুব একটা কাজে আসবে না। তাদের মতে, এ ধরনের প্রযুক্তি তখনই কাজ করবে যখন চালকরা হবে শিক্ষিত ও দক্ষ। সড়ক অবকাঠামো থাকবে উন্নতমানের। চালকদের মধ্যে শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চালানোর প্রবণতা থাকবে। সড়কে কোনো ধরনের অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করবে না।

জানা যায়, ঢাকার ট্রাফিক মোড়গুলোকে আধুনিক করতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও জাপান থেকে আইটিএস প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ব্যয় হয়েছিল ৫২ কোটি টাকার মতো। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর আগেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অকেজো হয়ে পড়েছে তিন ইন্টারসেকশনে বসানো আইটিএসও। পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। প্রযুক্তিটি কাজ না করায় সংস্থাটির কর্মকর্তারা অবশ্য দায়ী করছেন রাজধানীতে চলমান উন্নয়নকাজকে।

এদিকে সম্প্রতি একনেকে অনুমোদন পেয়েছে ‘ইমপ্রুভিং দ্য রিলায়েবিলিটি অ্যান্ড সেফটি অন ন্যাশনাল হাইওয়েজ করিডোরস অব বাংলাদেশ বাই ইন্ট্রোডিউসিং অব ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (আইটিএস)’ প্রকল্পটি। দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোতে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে ঢাকা-পটুয়াখালী মহাসড়কের মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ৪০ কিলোমিটার অংশে পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্যের বিষয়ে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর বলছে, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও উন্নত সড়ক পরিবহন অবকাঠামো ও অপারেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এ আইটিএস মাস্টারপ্ল্যান। এর মাধ্যমে সওজ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে স্থাপন করা হবে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার এবং পাইলট প্রকল্প হিসেবে ৪০ কিলোমিটার সড়কাংশে আইটিএস বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ৫০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন; ২৫০ বর্গমিটার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপন ও সেটি পরিচালনার জন্য ৫৭৬ জন পরামর্শক নিয়োগ; আইটিএস মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন; সিসি ক্যামেরা, স্পিড এনফোর্সমেন্ট ক্যামেরা, ভ্যারিয়েবল মেসেজ সাইন, ভেহিকল ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন এবং আইটিএস বাস্তবায়ন-সংশ্লিষ্ট জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৩ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দেবে কোরিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা। বাকি প্রায় ৩৯ কোটি টাকার সংস্থান করবে বাংলাদেশ সরকার। বাস্তবায়ন হবে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুন মেয়াদে।

আইটিএস স্থাপন প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় পরিকল্পনা কমিশন তার মতামত হিসেবে বলেছে, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সময় ও জ্বালানি সাশ্রয়, যানজট, দূষণমুক্ত এবং দুর্ঘটনামুক্ত একটি দক্ষ সড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। যদিও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রকল্পটির সুফল পাওয়া কঠিন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান  বলেন, আইটিএস খুবই অত্যাধুনিক একটি প্রযুক্তি। তবে এ প্রযুক্তি সড়কের মাত্র ৫ শতাংশ সক্ষমতা বাড়াতে পারে। তার আগে সেই সড়কের সক্ষমতা অবশ্যই ৯৫ শতাংশে পৌঁছতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিবহন চালকদের একটা বড় অংশ শিক্ষিত নয়। তাদের মধ্যে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। নসিমন, করিমন, ইজিবাইকের মতো অসংখ্য অবৈধ যানবাহন সড়কে চলে। অসংখ্য গাড়ির ফিটনেস নেই, রুট পারমিট নেই। সড়ক অবকাঠামোতেও অনেক ব্যাকরণগত সমস্যা রয়েছে। এগুলো ঠিক না করলে আইটিএস প্রযুক্তি কোনো কাজেই আসবে না। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে আইটিএস দিয়ে কোথাও যানজট হলে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা সিসিটিভিতে দেখতে পাব। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।

আইটিএসের সুফল নিয়ে সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা যদিও বেশ আশাবাদী। বিষয়টি সম্পর্কে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান বলেন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসন, কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াসহ সবকিছুই সহজে আইটিএস প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি প্রযুক্তি। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখেই আইটিএস স্থাপনের কাজ করছি।

প্যা.ভ/ম